শোভনসুন্দর বসু : আবৃত্তি শিল্পে কিংবদন্তির ছোঁয়া যে দুটি মানুষ পেয়েছিলেন তার মধ্যে প্রদীপ ঘোষ অন্যতম। প্রথম কিংবদন্তি কাজী সব্যসাচী তার পর প্রদীপ ঘোষ। অন্য যে নাম গুলো অতীতে এসেছে তাঁদের একমাত্র মাধ্যম আবৃত্তি ছিলো না। যখন কোনো কোনো আবৃত্তি, গান, অভিনীত নাটক, সিনেমা পরিচিত হয়ে ওঠে শিল্পীদের নামে তখন কিংবদন্তির স্পর্শ লাগে। সত্যজিতের পথের পাচালী, হেমন্তর রানার, উত্তম কুমারের অগ্নীশ্বর, দেবব্রত বিশ্বাসের আকাশভরা সূর্যতারা, কনিকার দূরে কোথায় দূরে দূরে, সব্যসাচীর বিদ্রোহী, এই ভাবে অভিহিত হত প্রদীপ ঘোষের কামাল পাশা, প্রদীপ ঘোষের দেবতার গ্রাস। কবিতাকে পৌঁছে দিয়েছিলেন বাঙালীর ঘরে ঘরে। আমাদের প্রজন্মের অনেকেই প্রদীপদার কন্ঠে কামাল পাশা শুনে আবৃত্তি শিল্পের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
নয়ের এর দশকে তদানীন্তন পঃবঃ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের আধিকারিক শ্রী অংশু শূর ভারত সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছিলেন। যদিও প্রদীপ ঘোষকে পদ্মশ্রীর জন্য মনোনয়ন করা হয়নি। এখনকার পঃবঃ সরকার সম্মান জানিয়েছিলেন। ওঁর আবৃত্তি জীবনের ২৫ বছর পূর্তীতে রবীন্দ্র সদনে আবৃত্তি শিল্পের প্রথম একক আসর হয়েছিলো। টিকিট কেটে বাঙালীরা প্রদীপ ঘোষের একার তিন ঘন্টারও বেশী সময় আবৃত্তি শুনেছিলেন। টিকিট না পেয়ে রবীন্দ্রসদন চত্তরে যত মানুষ ছিলেন তাতে তখন মনে হয়েছিলো নেতাজী ইন্ডোর স্টেডিয়ামও পূর্ণ হয়ে যাবে।
কোভিড আক্রান্ত হওয়ার অফিসিয়াল রিপোর্ট পাওয়ার আগেই চলে গেলেন প্রদীপ ঘোষ। মৃত্যুর পর হোয়াটস অ্যাপ এলো কোভিড পজেটিভ।
আজো মনে পড়ে ১৯৮২ সাল নাগাদ অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার মেদিনীপুর শহরের এক পাড়ার এক ভাঙ্গাচোরা দরজায় দুপুরবেলার ঠাঠা রোদে দরজার কড়া নাড়ার আওয়াজে বছর দশেকের এক ছেলে দরজার ছিটকিনি খুলে দ্যাখে দুজন সুপুরুষ দাঁড়িয়ে। দুজনেরই মাথায় সাদা চুল তবে বয়স বেশী নয়। একজন বললেন, আমরা কলকাতা থেকে এসেছি, শিবসুন্দর বাবু আছেন ?? ছেলেটি তার বাবাকে ডেকে আনলো। ছেলেটির বাবা ওঁদের দেখেই উচ্ছসিত। আসুন আসুন কি সৌভাগ্য। তখনই বাড়িতে লুচি, তরকারি তৈরী হলো। ছেলেটির খুব মজা, আজ লুচি খাওয়া যাবে। কিন্তু কে এলেন তাঁর পরিচয় তখনো পেলনা ছেলেটি। ছেলেটির মা ব্যস্ত হয়ে পড়লো। ছেলেটির বাবা ব্যস্ত পরিবার ও শহরের ইতিহাস নিয়ে আলোচনায়। বোঝা গেলো একজন থাকেন ইংল্যান্ডে, আর একজন কলকাতায়। তারপর আলোচনা চলে গেলো কবিতায়, আবৃত্তিতে।
তার আগে বুঝতেই পারেনি ছেলেটি যে এঁরা কারা? ছেলেটির মা, বাবাতো কখনো অতিথিদের নিয়ে এরকম ব্যস্ত হয়ে পড়েনি ? ছেলেটি শুনেছে এ বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ ও কাজী নজরুলেরও পায়ের ধুলো পড়েছে, তখন কি ঠাকুরদাদারা এরকম ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন? যখন ছেলেটির বাবা ছেলেটিকে বলে ''where the mind is without fear'' কবিতাটা আবৃত্তি করতে ওঁদের সামনে, তখনো ভদ্রলোকদের নাম জানেনা ছেলেটি।
আবৃত্তি শোনানোর পরে দ্বিতীয় লোকটি ছেলেটিকে জড়িয়ে ধরে বলেন, তোমার আবৃত্তিটা বিবিসির জন্য রেকর্ড করবো। সেই চিনতে পারা। প্রথমজনের নাম প্রদীপ ঘোষ এবং দ্বিতীয় জনের নাম দীপঙ্কর ঘোষ (লন্ডনের বিবিসির বাঙলা বিভাগের প্রধান)।
ছোট সনির টেপরেকর্ডারে ক্যাসেটে কত শুনেছে বিভিন্ন কবিতার আবৃত্তি, বাবাকে বলতে শুনেছে ওঁর কথা। বাবা চিঠি লিখেছেন কত ওঁকে। তারপর থেকে সরাসরি প্রদীপদা।
আজ শেষ যাত্রায় অন্তত পা মেলাতে পারলে একটু হয়তো শান্তি হতো প্রদীপ ঘোষ যাপনের দীর্ঘ সান্নিধ্য।