সৌমিত্র সেন
'তোরে বিনা মোহে চেইন নাহি'(২০০৪), 'আওগে জব তুম সাজনা' (২০০৭)-য় হয়তো তাঁকে বৃহত্তর ভারত চিনেছে, কিন্তু 'চাইল্ড প্রডিজি' রশিদের এটাই পরিচয় ছিল না; বরং তিনি মহা-ভারতীয় হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের অতল অপার স্রোতমালার মর্মে স্পন্দিত-রণিত এক মহিম পুরুষকণ্ঠ, যে-স্বর শুনে স্বয়ং ভীমসেন যোশী একদা আশ্বস্ত হয়ে বলেছিলেন, হিন্দুস্থানি সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি এবার নিশ্চিন্ত বোধ করছেন!
ভীমসেনকে-নিশ্চিন্ত-করা এহেন রশিদ চলে গেলেন। এই মুহূর্তে, প্রতি বছরের মতোই, কলকাতা ও রাজ্য জুড়ে চারিদিকে বসেছে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের আসর। চারিদিকে এখন বোল-তান-লয়কারির আবহ। শহরের সেই রঙিনমধুর আসরে ছন্দপতন ঘটল রশিদের মৃত্যুতে। একটা অন্ধকার নেমে এল। একটা তানপুরা থেমে গেল। ভারতের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের পরিবেশ থেকে চিরকালের জন্য এমন এক সুর হারিয়ে গেল, যেখানে বড় গভীর মমতায় আতিথ্য পেত 'দেশে'র ঔদার্য্য, 'দরবারি'র গাম্ভীর্য, 'কিরওয়ানি'র প্রেম, 'বাগেশ্রী'র মাধুর্য, 'বেহাগে'র রসতন্ময়তা। সেসব নিয়েই তিনি চিরতরে চলে গেলেন।
উস্তাদ রশিদ খানের জন্ম ১৯৬৮ সালের ১ জুলাই উত্তর প্রদেশের বদায়ুনে। রামপুর-সহসওয়ান ঘরানার শিল্পী তিনি। এই ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা ইনায়েত হোসেন খানের প্রপৌত্র রশিদ। মামা উস্তাদ নিসার হোসেন খানের কাছ থেকে রশিদের প্রাথমিক শিক্ষাগ্রহণ। শিখেছিলেন উস্তাদ গোলাম মুস্তাফা খানের কাছেও। এই গোলাম মুস্তফাই রশিদের সঙ্গীতপ্রতিভা প্রথম লক্ষ্য করেন। তবে বেশিরভাগ শিক্ষাটা নিসার হোসেন খানের কাছেই। শোনা যায়, নিসার হোসেন খান ভোর চারটেয় রেওয়াজে বসিয়ে দিতেন ছোট্ট রশিদকে। মূলত স্বরসাধনার উপরই জোর দিতেন তিনি। রশিদকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা একটিই নোট অনুশীলন করাতেন! এই কঠিন ট্রেনিংয়ের মধ্যে দিয়ে এসে রশিদ মাত্র এগারো বছর বয়সে তাঁর প্রথম কনসার্টটি করেছিলেন। সে-ও ছিল এক বিস্ময়!
রশিদের রামপুর-সহসওয়ান গায়কি গোয়ালিয়র ঘরানার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কিত। মধ্য-ধীর লয়ে জটিল ছন্দময় খেলা এই ঘরানার প্রাণ। রশিদ তাঁর বিলম্বিত খেয়ালে ধীরগতির এই স্টাইল দারুণ ভাবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সরগম এবং তানকারিতে তাঁর দক্ষতা ছিল চমকপ্রদ। মূলত দু'জনের গানের প্রভাব পড়েছিল তাঁর মধ্যে। একজম মহামহিম উস্তাদ আমির খান, অন্যজন ভারতরত্ন স্বয়ং ভীমসেন জোশী। কিন্তু রশিদের স্টাইল শেষ পর্যন্ত অনন্যই। নিজের শিক্ষা ও অন্যদের স্টাইল মিলিয়ে তিনি নিজের জন্য এমন এক 'সিগনেচার' তৈরি করেছিলেন, যা-যা দীর্ঘ দিন ধরে শুনতে-শুনতে শ্রোতাদের কানে-মনে এক গভীর ছাপ ফেলেছিল, যা তাঁর ব্যক্তিত্বকেই যেন মূর্ত করে তুলত।
বিশেষ করে খেয়ালে রশিদ ছিলেন অনন্য। সঙ্গীতশাস্ত্রবিদেরা বলে থাকেন, মূলত গোয়ালিয়র থেকেই খেয়ালের প্রবর্তন। উস্তাদ হাদ্দু খান এবং উস্তাদ হাস্সু খান ছিলেন গোয়ালিয়র ঘরানার আদিপুরুষ। সেই হাদ্দু-হাস্সু খানের ঐতিহ্যের ধারা এনায়েত হুসেন খানের মাধ্যমে বইত রশিদের সুরের কণিকায়-অনুচক্রিকায়। সুরের স্কিলের সঙ্গে শিল্পীহৃদয়ের আবেগ-উত্তাপ অদ্ভুত ভাবে মিলিয়ে-মিশিয়ে দিতে পেরেছিলেন রশিদ। যে সৃষ্টিতে মনের ভিতরে দোলা পেতেন শ্রোতা। সুরের অঙ্কের হিসেবের থেকেও যার আবেদন অনেক-অনেক বড়।
নিজের জন্য একটা ঘর ও ঘরানা, একটা স্টাইল ও মান দীর্ঘদিন ধরে তৈরি করেছিলেন রশিদ। কিন্তু সেখানেই আটকে থাকেননি। পরে সেটাও ভেঙেছেন। খাঁটি হিন্দুস্তানি সঙ্গীতের সঙ্গে মিশিয়েছেন নানা ধারা। পরীক্ষা করেছেন সুফি ফিউশন নিয়ে (নয়না পিয়া সে), বিখ্যাত ইনস্ট্রুমেন্টালিস্ট লুই ব্যাঙ্কসের সঙ্গে কনসার্ট করেছেন, অনন্য সেতারবাদক শাহিদ পারভেজের সঙ্গেও করেছেন মনে রাখার মতো যুগলবন্দি। এবং গেয়েছেন রবীন্দ্রনাথের গানও। একেবারে খোলা গলায় উদাত্ত ভঙ্গিতে তাঁর গাওয়া রবীন্দ্রগান যেন একটা খোলা হাওয়া! রশিদের মৃত্যর সঙ্গে সঙ্গে শেষ হয়ে গেল সেই নিরীক্ষা, সেই শিল্পযাত্রা, সেই ঐতিহ্য।
আরও পড়ুন: ছবি-সংসারের ঘরে-বাইরে এক অপরাজিত অভিযান
কিন্তু শেষ হয়েও সব শেষ হয় না শিল্পীর ক্ষেত্রে। একজন মরমি শিল্পীর শিল্পযাত্রা অন্তহীন, অনন্ত। যতদিন হিন্দুস্থানি উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত থাকবে, যতদিন উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতের একজন মরমি শ্রোতাও থাকবেন, ততদিন রশিদের গাওয়া বাগেশ্রী, ইমন, দেশ, কিরওয়ানি, শুদ্ধকল্যাণ, হংসধ্বনি, মেঘ, সোহিনী-- চির-অনুরণন তুলে যাবে রসিকের নিভৃত মনে।
মাত্র বছরখানেক আগেই সরোদ কিংবদন্তি উস্তাদ আমজাদ আলি খান রশিদ সম্পর্কে তাঁর মুগ্ধতা প্রকাশ করেছিলেন। আমজাদ আলি বলেছিলেন--'আমার মতে রশিদ এই মুহূর্তে দেশের শ্রেষ্ঠ ভোকালিস্ট।'
(দেশ, দুনিয়া, রাজ্য, কলকাতা, বিনোদন, খেলা, লাইফস্টাইল স্বাস্থ্য, প্রযুক্তির টাটকা খবর, আপডেট এবং ভিডিয়ো পেতে ডাউনলোড-লাইক-ফলো-সাবস্ক্রাইব করুন আমাদের App, Facebook, Whatsapp Channel, X (Twitter), Youtube, Instagram পেজ-চ্যানেল)